মৃত্যুসময়-অন্যসময়

4-2 পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরের কথা। সব রকমের পরীক্ষা আর ক্লাস শেষ। বাকি ছিল শুধু প্রজেক্টের কাজ। কারো কারো দুই একটা পরীক্ষা বাকি। কারো কারো পুরাই বিশ্রাম। সবাই অলরেডি অনুভব করতে শুরু করে দিয়েছি যে আমাদের চুয়েটে থাকার দিন শেষ। কয়েকদিন পর প্রজেক্টের কাজ শেষ করে আমলনামা হাতে পাইলেই বের হয়ে যে যে যার যার পথ দেখতে হবে। গেটের উপর হলের দুই তলায় বারান্দায় আমাদের আড্ডার স্পট ছিল। বারান্দায় দাড়ায় দাড়ায় দেখতাম অন্য ডিপার্টমেন্ট এর বন্ধুরা অনেকেই তখনি গেঞ্জি আর জিন্স প্যান্ট ছেড়ে ফরমাল ড্রেস আর ইন করা শুরু করে দিয়েছে। দেখে কেমন জানি একটা মিশ্র ফিল হত।
.
ওদিকে বাবা মায়ের চিন্তাও শুরু হয়ে গেছে সবার। “কিরে প্রেজেন্টেশনের ডেট দেয় নাই?” “কিরে আর কয় দিন।” “তোর কি কোন পরীক্ষা বাকি আছে নাকি?” ফ্রেন্ডসার্কেলের সবার একই অবস্থা।
.
এরকম সময়ে একেকজনের ভাবনা একেক রকম হয়। একশ্রেনীর ছাত্র অপেক্ষা করে কখন শেষ হবে আর কখন কোন কাজে জয়েন করবো। শেষ হয় না কেন! তারা খোজ খবর শুরু করে দেয়। সিভি লেখে। বাইরের ভার্সিটিতে মেইল করা শুরু করে। কেউ কেউ জিআরই এর বই কিনে পড়া শুরু করে, কেউ কেউ বিসিএস এর বই কিনে পড়া শুরু করে আবার কেউ এমবিএ এর জন্য পড়ে। কেউ কেউ সিভি পাঠাতে শুরু করে দেয়। এরা বাস্তবতাকে সহজে মেনে নেয়। এরা সামনে আসা দিনগুলোকে ফেলে যাওয়া দিনগুলোর চেয়ে সুন্দর করতে ব্যস্ত থাকে।
.
কিন্তু অন্য কিছু ছাত্র থাকে যারা বুঝে যায় তাদের সামনে আসা দিনগুলা এই দিনগুলার চেয়ে ভালো হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। তাদের সামনে যাবার চিন্তার চেয়ে পিছের মায়া কাটানোর চিন্তা থাকে বেশি। তারা তাই শেষ বারের মত এই ভালো দিনগুলোকে উপভোগ করে নেয়। এজ এ ম্যাটার অব ফ্যাক্ট, আমরা বেশিরভাগই ছিলাম শেষ দলে।
.
ইস ওইটা করা উচিত ছিল, ঐটা করে লস হয়েছে, ঘুমাতে গেলে এগুলা ভুলে থাকতে চাইতাম। ঘুম থেকে উঠে সকালবেলা রনেলের রুমে নইলে মাহতাবের রুমে চলে যাইতাম। রনেল, অর্নব, মাহতাব, আতিক, বাশার, রাকিব, সাইফুল, মিরাজ, সাদি, অনিক, রায়হান আমরা গল্প করতাম। নাহলে কোন কারন নাই কথা নাই এমনি গিয়ে বসে থাকতাম। ওরা যখন কোন কাজে শহরে যেত মন খারাপ হয়ে যেত। বিকালে মাঠে তো অবশ্যই যেতাম। ফুটবল খেলতাম। ওইখানে যোগ হত আরেক সেট ছেড়ে যেতে হবে এরকম প্রিয়মুখ। খেলে এসে রাতে হত নিজেরা রান্না করে খাওয়া দাওয়া। আমরা এটাকে বলতাম পার্টি। তারপর টিভি রুমে গিয়ে খেলা দেখা। তারপর বারান্দার আড্ডাস্পটে এসে পর্যালোচনা, তর্ক মাঝে মাঝে ঝগড়া। হলেই থাকি। কাল সকালেই দেখা হবে। তাও ওইখান থেকে রুমে যেতে কষ্ট লাগত। শেষ দিনগুলো বলে কথা। We enjoyed our time but at the same time we hated our life.
.
অন্যদের কথা জানিনা তবে আমার তখন প্রতিটা মুহুর্ত মৃত্যুর কথা মনে হত। মনে হত, এখনি মনে হচ্ছে ভাল দিনগুলো শেষ হয়ে গেল। আর গল্প, খেলা, একসাথে সব করা হবে না। তাহলে কেমন লাগবে যখন অফিসে বা কাজে আমাকে আর প্রয়োজন পড়বে না; সার্ভিস দেয়া শেষ করে যখন ডেস্ক গুটিয়ে শেষ জীবন কাটাতে চলে যেতে হবে? আর কেমনই বা লাগবে যখন সময় শেষ হয়ে আসবে; একটা করে বন্ধুর কিংবা প্রিয় মানুষের মৃত্যু সংবাদ আসবে? চোখের সামনে একটা করে আনইউজড আইডি বাড়তে থাকবে। আর কেমনই বা অনুভুতি হবে সব ছেড়ে পরপারে চলে যাওয়ার? আলটিমেট আমলনামাটা হাতে নেয়ার পূর্বে অপেক্ষা করার সময় যদি পাই তখনো কি মনে হবে “I enjoyed the most but now I hate my life”?

Leave a comment